নীল পাহাড় অভিযান

 
নীল পাহাড় অভিযান

* আব্দুর রহমান আল হাসান ।

প্রচন্ড হুইসেল ‌দি‌য়ে ‌ট্রেন‌টি থামলো স্টেশ‌নে। ‌লোক‌দের হু‌ড়োহু‌ড়ি, কু‌‌লি‌দের হাক-ডাক আর চালক‌দের অনবরত চেঁচামেচির ম‌ধ্যে ‌স্টেশ‌নে নাম‌লো র‌বিন। চা‌রি‌‌দি‌কে একবার চোখ বু‌লি‌‌য়ে ‌‌নি‌লো। এত লোকজন আগে কখ‌নো এক‌ত্রে ‌দে‌খে নি র‌বিন। অজঁপাড়া গা‌ঁয়ে কখ‌নো এত থা‌কে না। র‌‌বিন শক্ত ক‌রে তার মা‌য়ের হাত ধ‌রে আ‌ছে। তার বাবা দু্ই হা‌তে ‌তিনটা ব‌্যাগ বহন কর‌ছেন। এক কু‌লি এসে বল‌লো,

: আপনার কষ্ট হ‌‌চ্ছে। একটা ব্যাগ আমা‌কে ‌দিন।

: লাগ‌বে না। যাও।

: স্যার, এতো ব্যাগ বহন কর‌লে রা‌তে হ‌াত ব্যাথায় ঘুমু‌তে পার‌বেন না।

র‌বি‌নের বাবা কো‌নো কথা না ব‌লে হাট‌ঁতে লাগ‌লেন। কু‌লি ‌ছে‌লে‌‌টি ক‌য়েকবার অনুয় বিনয় ক‌রে ব্যর্থ হ‌য়ে ‌ফি‌রে গে‌লো।

র‌বিনরা স্টেশ‌নের বা‌হি‌রে এসে থামলো। সা‌থে সা‌থে একদল চালক "স্যার, কই যাইবেন" ব‌লে ঘি‌রে ধর‌লো তাদের। র‌বি‌নের বাবা চালক‌দের "আমার গা‌‌ড়ি আছে" ব‌লে তা‌ড়ি‌য়ে ‌দেন। চালকরা চ‌লে যাওয়ার পর র‌বি‌নের বাবা দোকান থে‌কে এক বোতল ঠাণ্ডা পা‌‌নি কি‌নেন আর র‌বিন‌কে একটা আইসক্রিম ‌কি‌নে দেন। ‌কিছুক্ষণ বিশ্রা‌মের পর র‌বি‌নের ব‌াবা জামাল সা‌হেব সিএন‌‌জি খুজ‌ঁতে বের হন। অ‌‌নেকক্ষণ দরদাম ক‌রে এক‌টি সিএন‌জি ‌ঠিক ক‌রে র‌বিন‌দের ‌নি‌য়ে গন্ত‌ব্যে রওয়ানা দেন।


(২)

ঢাকার শহ‌রে এই প্রথম আসে র‌বিন। বাবা সরকা‌রি চাকু‌রিজী‌বি হওয়ায় কিছ‌ু‌দিন পর পর তা‌দের ‌নিবা‌সের প‌রিবর্তন ঘ‌‌টে। পূ‌র্বে চাদঁপু‌রের এক‌টা গ্রা‌মে তারা ‌ছিল। ‌সেখান থে‌কে আজ ঢাকায় আসে। তা‌দের ‌নি‌র্দিষ্ট কো‌নো গ্রা‌মের বা‌ড়ি নেই। যেখা‌নেই তার বাবার বদ‌লি হয়, সেখা‌নেই তা‌দের নিবাস হয়। এ যেন এক ভবঘু‌রে প‌রিবার।

ঢাকায় আসার পর সর্বপ্রথম জামাল সা‌‌হেবের কাজ হ‌লো ছে‌লে‌কে স্কু‌লে ভ‌র্তি করা‌নো। মগবাজার ক‌লোনী‌তে সরকা‌রি সহায়তায় কম ভাড়ায় তারা এক‌টি বাসা পে‌য়ে‌ছে। ঢাকার শহ‌রের সব জি‌নি‌ষের দাম বে‌শি। কমলাপুর থে‌কে মগবাজার আস‌‌তে সিএন‌জি চালক আড়াইশত টাকা ভাড়া রাখ‌লো। অথচ রাস্তা কত কম। ছে‌লে‌কে কোন স্কু‌লে ভ‌র্তি করা‌বেন, তা নি‌য়ে জামাল সা‌হেব খা‌‌নিকটা ‌চি‌ন্তিত। আশেপাশে খোজঁ খবর নি‌য়ে মগবাজা‌রে "হাজী মহ‌সিন বিদ্যা‌নিক‌তেন" এ র‌বিন‌কে ভ‌র্তি ক‌রি‌য়ে দি‌‌লেন। র‌বিন‌ নতুন স্কু‌লে এসে মহাখু‌শি। বছ‌রে তার দু্ই-‌তিনটা স্কুল প‌‌রিবর্তন করা লা‌গে। পূ‌র্বের স্কুলগু‌লো সব গ্রামীন প‌‌রি‌বে‌শে ছিল। এবা‌রের স্ক‌ুল হ‌‌লো শহু‌রে প‌‌রি‌বে‌শে। র‌বিন আগ থে‌কেই শহর সম্প‌র্কে জান‌তো। শহ‌রে ‌কোনো স্বাধীনতা নেই। গাছ-গাছা‌লি ‌‌নেই। ফ‌‌লের বাগান নেই। সারা‌‌দিন গৃহবন্দী হি‌সে‌বে সময় অতিবাহিত করা লা‌গে। তারপরও স্কু‌লে যে‌হেতু ‌কিছুটা সময় মুক্তভা‌বে হইছই করা যায়, তাই র‌বি‌‌নের স্কুলটা পছন্দ হ‌লো। প্রথম‌দিন র‌বি‌নের বাবা সকাল সকাল তা‌কে ঘুম ‌থে‌কে উঠিয়ে বা‌হি‌রে নি‌য়ে ‌গে‌‌লেন। তারা ক‌লোনী থে‌কে কিছুটা দূ‌রে এক‌টি হো‌টে‌লে ঢুক‌লো। সব‌কিছ‌ুর দাম আকাশচু‌ম্মি। গ্রা‌মে পাচঁ টাকায় দু্ইটা ‌সিঙ্গারা পাওয়া যায়। ঢাকায় এক পিস সিঙ্গারার দাম ১০ টাকা। জামাল সা‌হেব প‌‌রোটা আর ডাল-ভাজি কি‌নে ছে‌লে‌কে নি‌য়ে বাসায় রওয়ানা হ‌লেন। বাসায় ‌‌পৌ‌ছে সকা‌লের নাস্তা শে‌ষে র‌বি‌নের বাবা তা‌‌কে স্কু‌লে ‌নি‌য়ে আস‌লেন। ভ‌‌র্তির কাজ পূ‌র্বেই তার বাবা ক‌রে রে‌খে‌ছি‌লেন। আজ নি‌য়ে যাওয়ার পর প্রিন্সিপ‌্যাল স‌্যার তা‌কে জিজ্ঞাসা কর‌লেন,

: বাবা, তোমার নাম কি?

: মোঃ র‌বিন ‌শিকদার।

: আগে কোন স্কু‌লে প‌‌ড়েছ?

: গন্ডামারা সানরাইজ স্কুল।

: তোমা‌দের প্রিন্সিপ্যাল স্যা‌‌রের নাম কি ছিল?

: খাইরুল ইসলাম স্যার।

: আগে কোন ক্লা‌সে পড়েছ ?

: ক্লাস ফোর।

: নামতা পা‌রো?

: ‌জ্বি।

: বল‌তো , ৩×৯ কতো?

: ৩×৯=২৭

: গুড। তোমার ভ‌র্তি সাক‌সেসফুল।

এভ‌া‌‌বেই র‌বিন হা‌জি মহ‌সিন ‌বিদ্যা‌নিক‌তে‌নে ভ‌র্তি হ‌লো। স্ক‌ুল ছু‌টি হ‌লে তার মা আস‌বেন ব‌লে র‌বি‌নের বাবা তার নতূন সরকা‌রি চাকু‌রি‌তে চ‌লে গে‌লেন।


(৩) 

পাক্কা চারঘন্টা ‌শেষ হওয়ার পর স্কু‌লে টি‌ফি‌নের সময় দি‌লো। এতক্ষণ সে স্কু‌লের কা‌রো সা‌থেই ভা‌‌ল‌োভা‌বে প‌রি‌চিত হয় নি। তা ছাড়া ‌টি‌ফিন ক‌্যা‌রিয়া‌রে ‌টি‌ফিন দোকান ‌থে‌কে কি‌নে খাওয়ার মত তার কা‌ছে টাকা নেই। সে স্কুল মা‌‌ঠের এক‌কো‌ণে ব‌সে রই‌‌লো। অনেকে এ সম‌য়ে খেলাধূলা কর‌‌ছে। এমন সম‌য়ে ‌কেউ একজন এসে তার পা‌শে বস‌লো। প্রথ‌মে সে ‌‌নি‌জের প‌রিচয় দি‌লো। "আমার নাম আহমাদ। ক্লাস ফাইভে প‌ড়ি। তু‌মিও তো ক্লাস ফাই‌ভে প‌ড়ো? 

র‌‌বিন হ্যা-সূচক মাথা নাড়‌লো। তখন তা‌কে আহমাদ বল‌লো,  

: তু‌মি কি পূর্ব‌ে ঢাকার ‌কো‌নো স্কু‌লে প‌ড়েছ? 

: না । আমি এই প্রথম ঢাকায় আসলাম।  

: তাহ‌লে ‌তো তু‌মি ভাগ্যবান।  

র‌বিন অবাক হ‌‌য়ে বল‌লো, কীভা‌বে? 

কারণ, আমরা শহ‌রে থাক‌তে থাক‌তে নি‌জে‌দের‌কে জেল বন্দী ম‌নে হয়। শহর আস‌লেই খুব বা‌জে জায়গা। তু‌মি তো গ্রা‌মে ছি‌লে। মুক্ত ‌‌বিহঙ্গ‌ে পা‌‌খির মত ছুটাছু‌টি কর‌তে পে‌রেছ।  

এমন সময় ক্লা‌‌সের ঘন্টা প‌ড়ে গেল। আহমাদ বল‌লো, চ‌লো ক্লা‌সে যাই। টি‌ফি‌নের পর ইং‌রে‌জি স্যা‌রের ক্লাস। ক্লা‌সে এসে স্যার বল‌লেন,  

: কি‌রে তোরা গরুর রচনা মুখস্ত ক‌রে‌ছিস? 

: ‌জ্বি স্যার। (ছাত্ররা সমন্বয়ে বল‌লো)  

 ইং‌রে‌জি স্যার র‌বি‌নের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বল‌লো, কি‌রে তুই নতুন আস‌লি ন‌‌াকি? 

র‌বিন ভ‌‌য়ে ভ‌য়ে মাথা নাড়‌লো। তারপর স্যার বল‌লেন, 

:আগে কোন স্কু‌লে প‌ড়ে‌ছিস? 

: গন্ডামারা সানরাইজ স্কুল।  

: ‌‌তো‌দের ইং‌রে‌জি কে পড়া‌তো? 

: হাসান স্যার। 

: ও তুই হাসা‌নের ছাত্র। আমি তো ব্যাটা হাসা‌নের বেস্ট ‌ফ্রেন্ট। হো…..হো…….হো…….। হাসান তো খুব ভা‌লো ইং‌রে‌জি পা‌রে। দে‌খি তার ছাত্র কেমন পা‌রে? " এই ব‌লে স্যার র‌বিন‌কে গরুর রচনা ইং‌রে‌জি‌তে লিখ‌তে বল‌লেন। প্রায় দশ ‌মি‌নিট পর র‌বিন স্যার‌‌কে খাতা দেখা‌লো। র‌বি‌নের রচনা দে‌খে স্যার খুব খু‌শি হ‌‌লেন এবং বল‌লেন, "সাবাস ব্যাটা। আমার বন্ধু হাসা‌নের মর্যাদা তু্ই রে‌‌খে‌ছিস।" ক্লা‌সের অন্যান্যরাও র‌বি‌নের খাতা দেখ‌‌লো। ক‌য়েকজন রচনাটা ছা‌পি‌য়ে তা‌দের ‌দি‌তে বল‌লো। র‌বি‌নের ইং‌রে‌জি স্যার তা‌কে এক‌টি হাতঘ‌‌ড়ি গিফট কর‌লেন। অব‌শে‌‌ষে ইং‌রে‌জি স্যা‌রের ঘন্টা শেষ হ‌লো। একে একে ধারাবা‌হিকভা‌বে ক‌য়েকটা ঘন্টা শে‌ষে স্কুল ছু‌টি হ‌লো। তখন ক্লা‌সের অন‌্যান্যরাও র‌বি‌নের সা‌থে প‌রি‌চিত হ‌লো। ক্লাস শেষে র‌বি‌‌নের মা চ‌লে এসেছেন। তাই সে মা‌য়ের সা‌থে বাসায় ফি‌‌রে গে‌লো।  


(৪) 

র‌বিন মগবাজার ক‌লোনীর পার্ক‌ে ব‌সে আ‌ছে । এখা‌নে দোলনা , মানব ‌ঢে‌কি , পি‌চ্ছিলবোর্ড ছাড়া আর কিছু নেই । কেন যেন র‌বি‌নের মন আস্তে আস্তে খারাপ হ‌তে থা‌কে । সে ভা‌বে , "গ্রামেই তো ভা‌লো ‌‌ছিলাম । "  

এমন সময় তার ভাবনায় ছেদ প‌ড়ে একজ‌নের ডা‌কে । এক‌টি ছোট্ট ছে‌লে দা‌ড়ি‌য়ে আছে । র‌বি‌‌নের সমবয়সী হ‌বে । সে র‌বিন‌কে ব‌লে , তোমরা ‌কি নতূন এসেছ ? র‌বিন হ‌্যা-সূচক মাথা না‌ড়ে । ছে‌লে‌টি ব‌লে, আমার নাম হি‌মেল । র‌বিন ব‌লে , আমার নাম র‌বিন ।  

: আমি কি তোমার বন্ধু হ‌তে পা‌রি ? (হি‌মেল ব‌লে) 

: অবশ‌্যই । আচ্ছা তোমরা ‌কি খেলাধূলা ক‌রো ? 

: হুম । আমরা ‌‌ক্রি‌কেট , কাবা‌ডি , গোল্লাছুট ‌খে‌লি।  

হি‌মেল র‌বিন‌কে তা‌দের বাসায় নি‌য়ে যায় । তার মা র‌বিন‌কে দে‌খে খুব খু‌শি হন । ‌তি‌নি ব‌‌লেন , তোমার আম্মু‌কে একবার আমা‌দের বাসায় নি‌য়ে এ‌সো । হি‌মেল‌দের বাসায় টি‌ভি ছ‌ি‌লো । র‌বি‌নের ‌প্রিয় কার্টুন হ‌লো shaun the sheep . হঠাৎ সে টি‌ভি‌তে সাউন দ্য শী‌পের এক‌টি ইপিসোড দেখ‌তে পায় । ‌সে হি‌মেল‌কে ব‌লে , এই কার্টুনটা দে‌খি । আমার প্রিয় কার্টুন এটি। কার্টুন দেখার মা‌ঝে হি‌মে‌লের মা তা‌‌দের জন্য হালকা নাস্তা নি‌য়ে এলেন । প্রায় অনেকক্ষণ কার্টুন দেখার পর র‌বিন বা‌হি‌‌রে তা‌কি‌য়ে দ‌েখে , সন্ধা হ‌য়ে আস‌ছে । তখন সে দ্রুত বাসায় রওয়ানা হ‌য়ে যায় । কারণ , মা না জা‌নি আবার চিন্তা ক‌‌রে ব‌সে । 


(৫)

র‌বি‌নের পড়ার টে‌বি‌লে ব‌সে আ‌‌ছে । ক্লাস ফাইভের বাংলা বই তার সাম‌নে খোলা । ‌সে কিছু‌তেই পড়ায় মন বসা‌তে পার‌ছে না । রাস্তায় গা‌ড়ি, ‌‌রিকশা, মটরসাই‌কে‌ল আর বাই-সাই‌কে‌লের ক্রিং ক্রিং শ‌ব্দে তার পড়ায় বিঘ্ন ঘট‌ছে। র‌বি‌নের বাবা জামাল সা‌হেব ওয়েটিংরুমে ব‌সে অফিসের কাজ কর‌ছেন । সে তার বাবার নিকট যায় । জামাল সা‌হেব তার দি‌কে জিজ্ঞাসু দৃ‌ষ্টি‌তে তাকা‌লেন । র‌বিন বল‌লো , বাবা, বা‌হি‌রে গা‌ড়ি-‌ঘোড়ার শ‌ব্দে পড়‌তে পার‌ছি না । ঢাকায় আমার কিছু‌‌তেই ভা‌লো লাগ‌ছে না ।‌ তু‌মি চাকু‌রি বদল ক‌রে গ্রাম‌ে চ‌লো । 

জামাল সা‌হেব ছে‌লে‌‌কে কা‌ছে টে‌নে বসা‌লেন । বল‌লেন ,

বাবা , লেখাপড়ার জন্য জীব‌নে কিছু কষ্ট কর‌তে হয় । ঢাকায় তো ত‌ুমি মাত্র নতুন এসেছ । তাই তোমার কষ্ট হ‌চ্ছে । কিছু‌দিন যাক , তারপর তু‌‌মি অভ্যস্ত হ‌য়ে পড়‌বে । এরপর তি‌নি ছে‌লে‌‌কে তার ছোট‌বেলার কা‌হিনী শুন‌া‌লেন । বল‌লেন , 

আ‌‌মি যখন ক‌লে‌জে স‌বেমাত্র ভ‌র্তি হই তখনই দে‌শে যুদ্ধ ‌লে‌গে যায় । আমি তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম । আমরা তখন প্রায়ই ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ে আসা-যাওয়া করতাম । শেখ মু‌জিব তখন বাংলার অসহায় মান‌ু‌ষের আশার আলো ছিল । কিন্ত‌ু তৎকালীন পা‌‌কিস্তানীরা তা‌‌কে একদমই সহ্য কর‌তে পার‌তো না । ‌তি‌নি সে সময় তি‌নি প্রায়ই জে‌লে থাক‌তেন । পা‌কিস্তান সরকার তা‌কে কো‌নো এক নি‌‌র্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত ক‌রে কারাগা‌রে ‌প্রেরণ ক‌রে । ‌দোষমুক্ত হ‌য়ে যখন শেখ সা‌হেব কারাগার ‌থে‌কে বের হন , জেল গে‌টেই তখন আরেক মামলার আসামী হ‌য়ে আবার জে‌লে ডু‌কেন ।এভা‌বে চল‌তে থা‌কে মা‌সের পর মাস । সন ১৯৬৯ পে‌রি‌য়ে ১৯৭০ আসে । কা‌লের চাকা ঘু‌রে আসে ১৯৭১ । শুরু হয় বাঙ্গালী জা‌তির সংগ্রাম । বছ‌‌রের শুরু থে‌কেই পা‌‌কিস্তা‌‌নীদের অরাজগতা আর "৭০ এর নির্বাচন" নি‌য়ে ব্যাপক আ‌লোচনা ও সমাল‌োচনা চল‌তে থা‌কে । এরইমা‌‌ঝে কয়েকবার ঢাকা অব‌রোধ দেয়া হয় । আমা‌‌দের ইউ‌নিভ‌ার্সি‌টি‌তে ক্লা‌সের অবস্থা ছিল , এই হ‌তো এই হ‌তো না । এরইমা‌‌ঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল‌য়ের ছাত্ররা ‌শেখ ম‌ুজিব‌কে " বঙ্গবন্ধু " উপাধী দেয় । মার্চ মা‌সের শুরু‌তে শোনা যায় , রেস‌কোর্স ময়দা‌নে বঙ্গবন্ধু ভাষণ ‌দি‌‌বেন । ৭ ই মার্চ‌ের সকাল থে‌কে রেস‌কোর্স ময়দা‌নে লোকজন জ‌ড়ো হ‌তে থা‌কে । ঢাকা,গাজীপুর,কু‌‌মিল্লাসহ আরো অনেক দূর-দূরান্ত থে‌কে লোকজন আস‌তে থা‌কে । আমরাও ইউ‌নিভ‌া‌র্সি‌টি থে‌কে গি‌য়ে‌ছিলাম । বেলা ১১ টার দি‌কে শেখ মু‌জিব ভাষণ শুরু ক‌‌রেন । "ভাই‌য়েরা আমার , আজ দুঃখ ও ভারক্রান্ত হৃদয় ‌নি‌য়ে আপনা‌দের সাম‌নে হা‌জির হ‌য়ে‌ছি । আপনারা সবই জা‌নেন এবং বো‌ঝেন । এভা‌বে ভাষণ চল‌তে থা‌কে । শে‌ষে তি‌নি হানাদার‌দের প্রতি‌‌রোধ কর‌তে ব‌লেন । এই ভাষ‌ণের পর শেখ ম‌জিব‌কে আবার গ্রেফতার করা হয় । ঢাকায় তখন লোকজন রাস্তা অব‌রোধ ক‌রে রা‌খে । ২৫ শে মার্চ রা‌তে বাঙ্গালীরা রাস্তা অব‌রোধ ক‌রে রে‌খে‌ছিল । এমন সময় সেনাবা‌হিনীরা হঠাৎ আক্রমণ ক‌রে । পু‌রো ঢাকায় তারা জাহান্নাম কা‌য়েম ক‌রে । তারা সেটার নাম দেয় " অপা‌রেশন সার্চলাইট " । প‌রেরদিন ২৬ মা‌র্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় । 

র‌বিন ‌জিজ্ঞাসা ক‌রে ,বাবা ,তখন থে‌কেই কি ‌তোমরা যুদ্ধ শুরু ক‌রো ?

জামাল সা‌হেব বল‌লেন , হুম । 

: তু‌মি তখন কি ক‌রে‌ছি‌লে ? 

: যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই আমি ঢাকা ত‌্যাগ ক‌রি । আমা‌দের বাড়ী ছিল শ‌রীয়তপুর । গ্রা‌মে যে‌তে তখন খুব কষ্ট হ‌য়ে‌ছি‌লো । রাস্তায় গাড়ী নেই । নদী‌তে লঞ্জ নেই । বু‌ড়িগঙ্গা নদী‌তে তখন এত প‌রিমা‌ণে লাশ ভ‌েসে উ‌ঠে‌ছিল যে , লা‌‌শের কার‌ণে নদীর পা‌‌নি দেখা যেত না । 

র‌বিন এ কথা শু‌নে খুবই চি‌ন্তিত‌বোধ ক‌রে ।" এত লোক যু‌দ্ধে মারা গি‌য়ে‌ছে ? যাক , তার বাবা বে‌চে ছি‌লেন । " ম‌নে ম‌নে ভা‌বে সে । র‌বি‌নের বাবা বল‌তে লাগ‌লেন , শে‌ষে আম‌ি শরীয়তপু‌রে অনেক কষ্ট ক‌রে পৌছাই । আমার বাবা-মা আমা‌কে যু‌দ্ধে ‌যে‌তে দি‌বে না‌‌কি তা নি‌য়ে আমি খা‌নিকটা চি‌ন্তিত ছিলাম । প্রথ‌মে ভাবলাম , তা‌দের না জা‌‌নিয়ে চ‌লে যাই । ‌কিন্তু পরক্ষণে বি‌বে‌কের কা‌ছে বাধাপ্রাপ্ত হলাম । কারণ , আ‌‌মি ছিলাম প‌রিব‌া‌রের বড় ‌ছে‌লে । অব‌শে‌ষে আমি বাবা-মা‌য়ের সা‌থ‌ে এ বিষ‌য়ে আ‌লোচনা করার ইচ্ছা করলাম । কিন্তু আমি কো‌নো সু‌যোগ পা‌চ্ছিলাম না । হঠাৎ ক‌রেই এক‌টি সু‌যোগ পে‌য়ে গেলাম । 


(৬)

আমার বাবা এক‌দিন ঘ‌রে এসে বল‌লেন , জামাল ,শুনলাম পা‌শের গ্রা‌মের অনেকেই যু‌দ্ধে যা‌‌চ্ছে । আ‌মি চাই , তু‌মিও যাও । 

এ কথা শু‌নে আমি খুবই খু‌শি হলাম । কিন্তু বাধ সাধ‌‌লেন আমার মা । ‌তি‌নি বল‌‌লেন , য‌দি তু‌মি যু‌‌দ্ধে মারা যাও , তাহ‌‌লে কি হ‌বে ? তখন আমার আব্বা মা‌কে বল‌লেন , য‌দি ত‌ুম‌ি ‌নি‌জের ছে‌লে‌কে এভা‌বে আটকাও , তাহ‌লে আর এই দেশ স্বাধীন হ‌তে পার‌বে না । বাবা মা‌কে বু‌ঝি‌য়ে রাজী করা‌লেন । পরদিন সকালে আমি ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । টানা চার মাস ট্রেনিং শেষে নভেম্বরের দিকে আমরা ঢাকা আসলাম । ঢাকায় তখন আমরা গেরিলা আক্রমণ করতাম । পাশাপাশি ঢাকা-গাজীপুর রোড , ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে আমরা পাকিস্তানীদের আক্রমণ করতাম। এভাবে ১৫ই ডিসেম্বর চলে আসলো । শুনতে পাচ্ছিলাম দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে । ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পন করবে । ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পন করে । আমরা পাই , একটি মুক্ত স্মাধীন ভূ-খন্ড এবং নিজস্ম পতাকা । এতক্ষণ রবিন তার বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সে তার বাবাকে বললো , আচ্ছা , ৭১ সালের ঢাকা আর বর্তমানের ঢাকার মধ্যে পার্থক্য কতুটুকু ?

জামাল সাহেব বললেন , সে সময় তো ঢাকায় গাছ-গাছালী ভরপুর ছিল । এখন তো ঢাকায় সে সব আর নেই । ঢাকায় এখন বিশাল বড় বড় বিল্ডিং তৈরী হয়েছে ।

আচ্ছা রবিন , অনেকক্ষণ তো আমরা গল্প করলাম । চলো রাতের খাবার খেয়ে আসি । তোমার আম্মু অপেক্ষা করছে । পরদিন সকালে রবিন স্কুলে গেল। তার ক্লাসের অন্যান্যদের সাথে সে পরিচিত হলো। এতে বন্ধুর সংখ্যা আরো বেড়ে গেল । ক্লাসের অন্যান্যদের সাথে সে পরিচিত হলো। এতে বন্ধুদের সংখ্যা আরো বেড়ে গেল । ক্লাসে সে আহমাদের সাথে বসলো । আহমাদ রবিনকে বললো , আচ্ছা রবিন, তুমি কি গল্পের বই পড়ো ?

রবিন বললো, হুম ।

: কি কি গল্পের বই তুমি পড়েছ ?

: মা, ফেলুদা, হিমু , তিন গোয়েন্দাসহ আরো অনেকগুলো।

: ওয়াও, তাহলে তো অনেকগুলো পড়েছ । জানো, আমার বাবা হলেন লাইব্রেরীয়ান। আমাদের বাসায় এমন কোনো গল্পের নেই , যেটা আমাদের নিকট নেই ।

: সত্যি, তাহলে তো তোমার থেকে আমার বই ধার নেয়া দরকার ।

এ কথা শুনে আহমাদ হেসে বললো , অবশ্যই । আমার আরো দুই-তিনজন বন্ধু রয়েছে , যারা আমার থেকে বই নেয় । রবিন তাকে একটা বইয়ের নাম বলে বললো , এটা তুমি কাল নিয়ে এসো।

এভাবে একদিন দুইদিন করে দীর্ঘ ছয়মাস চলে গেল । আহমাদসহ রবিনের আরো অনেক বন্ধু হয়ে গেল । একদিন স্কুল থেকে ঘোষণা দেয়া হলো , স্কুলেন অধীনে সবাই এক সপ্তাহের ট্যুরে যাবে । এ কথা শুনে রবিন খুব খুশি হলো। ঢাকায় এতদিন খাচাঁর মধ্যে আটঁকে থাকার পর এবার মুক্তভাবে ৬-৭ দিন থাকা যাবে । এখনো স্কুল থেকে জানানো হয় নি , তারা কোন জেলায় যাবে । রবিন চাচ্ছে , খাগড়াচড়ি যেতে । সেখানে অনেক পাহাড় আছে । সে প্রিন্সিপ্যাল স্যারর নিকট গেল । স্যার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন , কিছু বলবে রবিন ?

: স্যার , শুনলাম স্কুল থেকে নাকি ট্যুরে যাবে ?

: হুম । তোমরা কিছুদিন ঢাকার বাহিরে থাকলে ব্রেন পরিস্কার হবে ।

: কিন্তু স্যার কোন জেলায় যাওয়া হবে ?

: এই তো চট্টগ্রামের ঐই সাইটে যাবো ।

: স্যার , আমরা পাহাড় দেখতে চাই ।

: আচ্ছা , তোমাদের পাহাড় দেখতে নিয়ে যাবো ।

রবিন খুশি হয়ে ফিরে গেল । সে তার সহপাঠী বন্ধুদের এই সংবাদটা দিলো । একজন বললো ,

আচ্ছা আমরা পাহাড় দেখতে গিয়ে যদি কোনো মিশন পরিচালনা করি , তাহলে কেমন হয় ?

সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো , কিসের মিশন ?

সে বললো , পাহাড়ের মধ্যে অনেক সময় ডাকাতরা আস্তানা গেঁড়ে রাখে । আমরা ঐ ডাকাতদের ধরবো । এটা শুনে সবাই ভয়ে ভয়ে বললো , না ভাই । আমরা এই মিশনে নেই । ডাকাতদের কাছে ভয়ঙ্কর অস্ত্র থাকে । সেই অস্ত্র ‍দিয়ে তারা আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে ।


(৭)

রবিন সকালে স্কুলে আসার পূর্বে পত্রিকা পড়লো। সেখানে একটি সংবাদ সে দেখতে পেল । গতকাল চট্টগ্রাম শহরে ডাকাতরা হঠাৎ আক্রমণ করে ৫০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। পুলিশ তাদেরকে ধাওয়া করলে তারা একটি পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করে । পুলিশ সেই গুহায় অভিযান চালালে তাদেরকে খুঁজে যায় নি। ধারণা করা হচ্ছে , তারা অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে চুপিসারে সরে গিয়েছে। কিন্তু কোথায় গিয়েছে তা এখনো জানা যায় নি। আর মাত্র দুইদিন পরই রবিনরা খাগড়াচড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে । রবিন মনে মনে একটি রোমাঞ্ন অনুভব করলো । সে স্কুলে গিয়ে এ বিষয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করলো । বন্ধুরা সকলেই সম্মতি প্রকাশ করলো । এবার ট্যুরে যাওয়ার পালা ।

স্কুলের সামনে আজ দুইটা বাস দাড়িয়ে আছে । রবিনের বাবা রবিনকে ট্যুরে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে দিয়েছেন । বন্ধুরা সবাই একসাথে বাসে বসেছে ।রবিন বাসে বসে প্রকৃতি দেখতে লাগলো । কি সুন্দর করে আল্লাহ এই পৃথিবী সাজিয়েছেন । গাছ-গাছালী , গ্রামীন ঘর-বাড়ী , সবই যেন ছবির মত সুন্দর । রবিনের বন্ধু জাফর একটি ক্যামেরা সাথে করে নিয়ে এসেছে । সে কিছুক্ষণ পর পর বিভিন্ন দৃশ্যের ফটো তুলছে । রবিন ও কয়েকবার ক্ষেতের ছবি তুললো । বাস দীর্ঘ যাত্রার পর এক স্থানে থামলো । সেখানে সবাই নাস্তা করলো । রবিন কিছুক্ষণ আশ-পাশ ঘুরে দেখলো । এলাকাটি তার পরিচিত লাগছে । হঠাৎ মনে হলো , ছোটবেলায় একবার তার বাবা এখানে বদলি হয় । তখন সে এখানের এক স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়েছিল । এখন তার তেমন সময় নেই । অন্যথায় সে তার পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করে আসতো । প্রায় আধ ঘন্টা বিরতির পর রবিনরা আবার যাত্রা শুরু করলো । স্যার বললেন , আর মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে তারা খাগড়াচড়ি পৌছে যাবে । রবিনরা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো , আমরা পাহাড়ের মধ্যে শুরুতেই অভিযান পরিচালনা করবো না এতে ডাকাতদের চোখে পড়ে যাবো আমরা । আমরা ঘুরাঘুরিচ্ছলে ডাকাতদের আস্তানা বের করবো ।


(৮)

এই মুহুর্তে রবিনরা খাগঁড়াচড়ি বিখ্যাত ফাইভ স্টার হোটেলে আছে । সেখানকার পরিবেশটা খুব সুন্দর । হোটেলের সামনের লবিটা অনেক বড় । রবিনদের স্কুল থেকে এই পিকনিকে দেড়শো ছাত্র-ছাত্রী এসেছে । সবাই সবার মত ঘুরাঘুরি করছে । সবার নিকট ছোট মোবাইল ফোন আছে । রবিন , আহমাদসহ আরো কয়েকজন এক পাহাড়ে উঠলো । পাহাড়ের চূড়ায় পৌছাতে তাদের পৌনে এক ঘন্টা সময় লাগলো । তবে খাগঁড়াচড়িতে এর থেকেও আরো বড় বড় পাহাড় রয়েছে । রবিনরা এত উপরে উঠার পর সকলে হাপিঁয়ে গিয়েছে । তারা সেখানে বিশ্রামের জন্য সবাই বসে রইলো । তবে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না । কারণ , মাথার উপর প্রচন্ড রোদ । সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো । পাহাড়ে উঠা যেতটা সহজ , নামা তার থেকেও অনেক কঠিন । তাদের নামতে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগলো । রবিনরা কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেলে চলে আসলো । অনেকে এখনো আসে নি । হোটেলের লবিতে রবিনদের সাথে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সঙ্গে দেখা হলো ।

স্যার জিজ্ঞাসা করলেন , সবাই কি এখনো আসে নি ?

রবিন বললো , না স্যার ।

স্যার বললেন , যারা এখনো আসে নি , তাদেরকে ফোন দাও ।

রবিনরা লবিতে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর হোটেলের কামরায় ফিরে আসলো । সবাই তাদের অভিজ্ঞতা পরস্পর বলাবলি করছে । প্রায় ২০ মিনিট পর তাদের ক্লাসের অন্যান্যরা ‍ফিরে আসলো । সবাইকে খুব আতঙ্কিত দেখাচ্ছে ।

আহমাদ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলো , কিরে , তোদের সবাইকে এমন দেখাচ্ছে কেন ? মনে হয় যেন ভূত দেখেছিস ?

তাদের মধ্য থেকে একজন বললো , হুম রে ভাই , একটা নয় , আটটা। আটটা ভূত দেখেছি ।রবিনরা কিছুই বুঝতে পারছে না । তারা পরস্পর চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো । এরপর রবিন বললো , তোরা কোথায় ভূত দেখেছিস ?

: পাহাড়ে ।

: পাহাড়ে ভূত আসবে কোথা থেকে ?

: আমরা যখন পাহাড়ে উঠেছিলাম , তখন দেখেছি।

: কোন পাহাড় সেটা ?

: নীল পাহাড় ।

এভাবে রবিন তাদের থেকে সকল তথ্য জেনে নিলো ।

বিষয়টা রবিন এবং অন্যান্যদের চিন্তিত করে তুললো । রবিন আহমাদকে বললো , নীল পাহাড় তো একেবারে বর্ডারের সাথে । আমরা এখন বর্ডার থেকে অনেক দূরে আছি । আচ্ছা , কাল যদি আমরা নীল পাহাড়ের পূর্বপাশে হেলেন পাহাড়ে উঠি , তাহলে কেমন হয় ?

আহমাদ বললো , আমরা নীল পাহাড়েই যাই ।

: না । আমরা এখন নীল পাহাড়ে গেলে সেই ভূতদের চোখে পড়ে যাবো ।

: তাহলে হেলেন পাহাড়ে তুমি কি করবে ?

: সেখান থেকে আমরা নীল পাহাড়ে নজর রাখতে পারবো । কারণ , এই দিকটা থেকে নজর রাখার জন্য উপযোগী মনে হচ্ছে ।

: কিন্তু পাহাড় তো অনেক উঁচু । পাশাপাশি নীল পাহাড় থেকে নীল পাহাড় কিছুটা দূরে ।

: অসুবিধা নেই । আমাদের নিকট বায়নোক্যুলার এবং দূরবীন আছে ।

: ওহ্ । তাহলে তো মিশন শুরু করা যায় ।

দ্বিতীয় দিনের মিশনের জন্য রবিন প্রস্তুতি নিতে লাগলো । আহমাদসহ আরো ছয়জন তার সাথে যাবে । কিন্তু তখনি একটি বিপত্তি ঘটে । ঘটনাটি স্যার জেনে গেলেন । তখনি স্যার সবাইকে একসাথ করলেন । সব ছাত্র জড়ো হওয়ার পর স্যার বললেন , পাহাড়ে ভূতের উপদ্রবের কথা আমরা জেনে গিয়েছি । সুতরাং ­আমরা আর খাগড়াচড়িতে থাকছি না । তোমরা সবাই তৈরী হয়ে নাও । আমরা কক্সবাজার যাবো ।

এ কথা শুনে রবিনরা আশাহত হয়ে গেল । তাদের এত প্ল্যান কি তাহলে মাঝপথেই থেমে যাবে ? সে স্যারকে বললো , স্যার ভূতের বিষয়টা তো এখনো শিওর নয় । আমরা আরো দু-একদিন থাকি । তারপর না হয় , কক্সবাজার যাবো । এ কথার পক্ষে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরাই স্যারকে বলতে লাগলো । অবশেষে আরো দুইদিন খাগড়াঁচড়ি থাকার কথা বললেন ।


(৯)

রবিন,আহমাদসহ ছয়জন হেলেন পাহাড়ে অবস্থান করেছে । রবিন বায়নোক্যুলার দিয়ে নীল পাহাড়ের দিকে নজর রাখছে। প্রায় আধ ঘন্টার বেশি সময় ধরে তারা সেখান থেকে নজর রাখছে । হঠাৎ পাহাড়ের উপরের এক স্থান থেকে বড় একটি পাথর সরে গেল ।ভিতরে গুহার মত একটি জায়গা ।সেখান থেকে ভূতের মত দেখতে পাচঁজন বেরিয়ে এলো ।রবিনের টিমের সকলেই এটি দেখলো । এখন দেখার বিষয় হলো , তারা কোথায় যায় । সেই পাচঁটি ভূত পাহাড় থেকে নিচে নামা শুরু করেছে । রবিনরাও দূর থেকে তাদের অনুসরণ করতে লাগলো । ডাকাতরা পাহাড় থেকে নামার পর ফাইভ স্টার হোটেলের দিকে যাত্রা শুরু করলো । রবিন তখনি বুঝতে পারলো , কি ঘটতে যাচ্ছে ! সে তৎক্ষণাৎ প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে ফোন দিয়ে পরিস্থিতি জানালো । স্যার কি করবেন , বুঝতে পারছেন না । রবিন বললো, স্যার আমার নিকট একটা প্ল্যান আছে । রবিন স্যারকে সম্পূন্ন প্ল্যানটি বললো । ডাকাতরা রাস্তায় নামার পর মুখ থেকে ভূতের মুখোশটি খুলে ফেললো । রাস্তার অনেকেই তাদের দিকে ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । ডাকাতরা ফাইভ স্টার হোটেলের পিছন সাইট দিয়ে দেয়াল টপকিয়ে ‍ভিতরে প্রবেশ করলো । গিয়েই তারা পড়ে গেল মহাবিপদে । কারণ , সেখানে অনেকগুলো ফুটবল রাখা । তারা ফুটবলে পা দিয়ে পড়ে গিয়ে কয়েকজনের কোমর ভেঙ্গে গেল । তারপরও তারা উঠে হোটেল অভিমুখে যাত্রা শুরু করলো । লবিতে কোনো লোকজন নেই । তারা লবি পার হয়ে হোটেলে প্রবেশ করলো । ইন্টারকমে রবিন বসে আছে । ডাকাতরা রবিনকে দেখে বললো , এই বাচ্চা , তুমি এখানে কি করো ?

: বসে আছি ।

: হোটেলের ম্যানেজার কোথায় ?

: পাচঁতলায় বিশ্রাম করছে ।

ডাকাতরা রবিনকে যিম্মি করে রাখতে চাইলো । যেই তারা রবিনকে ধরতে যাবে, অমনি টেবিলের নিচ থেকে আহমাদসহ উঠে ডিম নিক্ষেপ করতে লাগলো । তারা ডিম থেকে বাচাঁর জন্য সিড়িঁর দিকে দৌড় দিলো । সিড়িতে গিয়ে আবার বিপদে পড়লো । পুরো সিড়িঁতে মার্বেল বিছানো । মার্বেল দেখে তারা লিফটের দিকে দৌড় দিলো। কিন্তু লিফট বন্ধ । অবশেষে তারা উপায় না ‍পেয়ে হোটেল থেকে বের হলো । কিন্তু এখানে আরেক আতঙ্ক । লবিতে পুলিশ দাড়িয়ে আছে । যেই তারা আবার হোটেলে ডুকতে যাবে , দেখে এখন ইন্টারকমে স্বয়ং পুলিশ ইন্সপেট্টর আমজাদ খান দুই হাতে দুই পিস্তল তাক করে দাড়িয়ে আছে । উপায় না পেয়ে অবশেষে তারা স্যারেন্ডার করলো । হোটেলের মালিক , প্রিন্সিপ্যাল স্যার , ইন্সপেট্টর সাহেব সবাই রবিনের বুদ্ধিসত্তায় খুশি হলো । হোটেলের মালিক সবাইকে মানে সব ছাত্র-ছাত্রীকে গেস্ট হিসেবে রাখলো । রবিনদের ও নীল পাহাড় অভিযান সফল হলো ।


শুরু: ১৮/১১/২০২০ , সকাল ০৭:১০ মিনিটে ।

শেষ:০৬/০১/২০২১ , সকাল ০৯:১৫ মিনিটে ।

#buttons=(আমি সম্মত !) #days=(20)

আসসালামু আলাইকুম, আশা করি আপনি ভালো আছেন। আমার সম্পর্কে আরো জানুনLearn More
Accept !