* আব্দুর রহমান আল হাসান
মহাবিশ্বের জন্ম এক মহাবিস্ফোরণের পর। কিন্তু এই মহাবিস্ফোরণের পর এই দুনিয়া এত তাড়াতাড়ি একটা মৌলের সাথে অন্যটা বিক্রিয়া করেছিল, যা অন্য কোনো সময় হয় নি। আমরা বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যানে সময়কে অতি সুক্ষ্মভাবে গণনা করতে পারি। তবে তারপরও আমরা সাধারণত সময়ের সর্বনিম্ন পরিমাণ হিসেবে সেকেন্ডেকে ধরে থাকি। কিন্তু সেকেন্ড থেকেও কম সময়ের গণনার জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক ঘড়ি। সেই ঘড়িতে ন্যানো সেকেন্ড, পিকো সেকেন্ডের পরিমাপও করা যায়। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক কখনো ১ সেকেন্ডের কম সময়ে ঘটে যাওয়া দৃশ্যকে আলাদা করতে পারে না। তাই আমরা যখন ভিডিও দেখি, সেটা মূলত চলমান কোনো ছবি নয়। সেটা হলো বহু ফটোর সমন্বয়ে গঠিত একটি সিরিয়াল ভিত্তিক দৃশ্যমান বস্তু। আর সেটা সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যে দৃশ্য বা ফটো পরিবর্তন করে। তাই আমরা সেটা আলাদাভাবে ধরতে পারি না। কিন্তু এই সেকেন্ডের কম সময়েও ঘটে যেতে পারে অনেক কাহিনী। যার বিবরণ আমরা এখন পেশ করছি।
মহাবিশ্বের শুরুর সময়টাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় “প্ল্যাঙ্ক যুগ”। সেই যুগটার ব্যাপ্তিকাল কতক্ষণ ছিল, তা হয়তো আপনার বিশ্বাস করতে খানিকটা কষ্ট হবে। প্ল্যাঙ্ক যুগের সমাপ্তি হয় বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ১০-৪৩ সেকেন্ড পরে। অর্থাৎ ১ এর আগে আরো ৪৩ টা শূন্য থাকলে সেটাকে আপনি যত কম সময় ধরবেন, ততক্ষণ। সময় কিন্তু আমাদের নিকট শুরু হয় ১ থেকে। যেমন, সর্বনিম্ন সময় ১ সেকেন্ড। সেই হিসেবে উক্ত সংখ্যাটাকে যদি আমরা ভেঙ্গে লিখি, তাহলে হবে ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১ সেকেন্ড।কিন্তু এই প্ল্যাঙ্ক যুগটা যতই কম হোক, যতই ক্ষুদ্র হোক, সে সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিল ১০৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ১ এর পরে আরো ৩২ টা শূন্য। সেই তাপমাত্রাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রা। আর সেই যুগের সময় ছিল মহাবিস্ফোরণের ১০-৪৩ সেকেন্ড পরে। যেটাকে আমরা প্ল্যাঙ্ক যুগ নামে অবহিত করেছি।
এই যুগ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় “গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন” যুগ। এই যুগে চারটি মৌলিক বল আলাদা হয়ে যায়। আর এই যুগের সময়কাল ছিল মহাবিস্ফোরণের ১০-৪৩ থেকে ১০-৩৬ পর্যন্ত।
এরপর শুরু হয় “স্ফীতি যুগ”। এসময় একইসাথে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। মাত্র ১০-৪ সেকেন্ডে। অর্থাৎ ১০-৩৬ থেকে ১০-৩২ পর্যন্ত। এসময় মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়া শুরু করে। তাও স্বাভাবিক গতিতে নয়। দ্রুতগতিতে। এ যুগে মহাবিশ্বের আকার বেড়ে যায় ১০২৬ গুণ। অর্থাৎ ১ এর পর ২৬ টা শূন্য থাকলে যত বড় হবে, ততবড়।
এরপর শুরু হয় দুর্বল নিউক্লীয় বলের যুগ। তাদের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১০-২০ সেকেন্ড। এই যুগে সবল নিউক্লীয় বল আলাদা হয়ে যায়। তবে দুর্বল নিউক্লীয় বল আর বিদ্যুৎচৌম্বকীয় বল তখনো একসঙ্গে রয়ে যায়। এই যুগেই জম্ম হয় বেশ কিছু মৌলিক কণার। এগুলো আমাদের পরিচিত কণা নয়। ডব্লিউ, জেড ও হিগস বোসন কণাদের জম্ম এই যুগে। আর এই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে ১০-১২ সেকেন্ড পরে।
এরপর শুরু হয় অন্য একটি যুগের। এই যুগ মহাবিস্ফোরণের ১০-১২ সেকেন্ড থেকে ১০-৬ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই যুগের নাম হলো, কোয়ার্ক যুগ। এই যুগেই পরিচিত সকল কণা, কোয়ার্ক আর ইলেকট্রনের জন্ম হয়। আর সাথে সাথে নিউট্রিনো কণাও জন্মগ্রহন করে এই যুগে। এসময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা অর্ধেকে নেমে আসে। তাপমাত্রা হয় ১০১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই যুগে এসে মৌলিক বলগুলো সব আলাদা হয়ে যায়। এই যুগে শুধুমাত্র কোয়ার্ক আর ইলেকট্রনই তৈরী হয় নি। সাথে সাথে এদের প্রতিকণারাও তৈরী হয়েছিল। যেমন, ইলেকট্রনের প্রতিকণা পজিট্রন আর কোয়ার্কের প্রতিকণা অ্যান্টি-কোয়ার্ক। কোয়ান্টাম মেকানিকসের তথ্যমতে, কণা আর প্রতিকণাদের সংঘর্ষ ঘটলে দুটো কণা পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে দুটোই ধ্বংস হয়ে যায়। আইনিস্টাইনের ভর সমীকরণ তথ্যানুযায়ী পড়ে থাকে শুধু শক্তি।
কোয়ার্ক যুগের শেষ হওয়ার পর শুরু হয় হ্যাড্রন যুগ। এই যুগের ব্যাপ্তিকাল মহাবিস্ফোরণের ১০-৬ সেকেন্ড থেকে নিয়ে ১ সেকেন্ড পর্যন্ত। এই যুগে কোয়ার্ক কণাদের ছুটাছুটি অনেক কমে যায়। এ সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা নেমে আসে ১ কোটি ডিগ্রিতে।
হ্যাড্রন যুগ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় লেপটন যুগ। এই যুগের ব্যাপ্তিটা আগের সবগুলো যুগ থেকে খানিকটা বড়। এর ব্যাপ্তি প্রায় ৩ মিনিট। এই যুগে লেপটন আর প্রতি-লেপটন কণা মিলিত হয়ে ফোটন কণার জন্ম দেয়। এই ৩ মিনিটের পর থেকে পরবর্তী ১৭ মিনিট ধরে চলে নিউক্লীয় বিক্রিয়া। ফলে সক্রিয় হয়ে উঠে সবল নিউক্লিয় বল।
এর পর থেকে শুরু হয় ফোটন যুগ। এটা অনেক লম্বা। এর ব্যাপ্তিকাল মহাবিস্ফোরণের ৩ মিনিট পর থেকে ৩ লাখ ৪০ হাজার পছর পর্যন্ত। এ সময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমতে কমতে সর্বশেষে ৩ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে এসে ঠেকে। আমরা এখন আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যানে হয়তো জানি, সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা এই তাপমাত্রার কাছাকাছি। এরপর মহাবিশ্বে ফোটন কণাগুলো মুক্ত হয়ে যায়। কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সাথে সাথে দৃশ্যমান হয়ে উঠে মহাবিশ্ব।
এই ফোটন যুগের পরবর্তী যুগকে বলা হয় “ডার্ক এরা” বা অন্ধকার যুগ। যেহেতু মহাবিশ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। তাহলে আবার ডার্ক বলা হলো কেন? প্রশ্নটা নিশ্চই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এর উত্তর হলো, এই বিশাল সময়ে মহাবিশ্ব এতটা প্রসারিত হয়ে উঠলো যে, যেই ফোটন কণাগুলো রয়েছে, তা দিয়ে সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব আলোকিত করা সম্ভব নয়। এভাবে মহাবিশ্ব অন্ধকার হয়ে থাকলো প্রায় ১৫ কোটি বছর। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ সময়টাতেই মহাবিশ্বে রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি রাজত্ব করেছে।
সেই গল্প না হয় অন্য কোনোদিন বলবো।