** আব্দুর রহমান আল হাসান **
১৫ বছর পর যখন পুরোনো কোনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে, তখন কেই-বা স্থির থাকতে পারে? নিজের অতীত সত্ত্বাকে তখন ভিন্নরুপে আবর্তিত হতে দেখা যায়। নিজেকে তখন হারিয়ে ফেলি এক অতীত স্বর্গপানে। যেখানে অনাবিল সুখ-শান্তি ব্যতিত কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। নেই কোনো ভেদাভেদ। নিজের সেই সত্ত্বাটি আমার কাছে খুব প্রিয়। কারণ এমন একটা মুহূর্ত ৩৬৫ দিনের মধ্যে হাতেগোনা দুই-তিনদিন দেখা যায়। শৈশবে সবাই খেলনা দিয়ে খেলতে পছন্দ করে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। তবে শৈশবের দুরন্ত সময়ের কোনো জিনিষ পরবর্তী ভবিষ্যতে অক্ষত থাকে না। বাচ্চারা গড়ার চেয়ে ভাঙ্গতে পছন্দ করে। তাদের কাছে ভেঙ্গে ফেলার মধ্যে আলাদা এক আনন্দ আছে। সেই আনন্দ হাঁটে কিনতে পাওয়া যায় না। বড়ই অভাব তাঁর। আমার অতীতে যত খেলনা ছিল, তার কোনোটাই হয়তো আজ আস্ত নেই। যদি না বাবা-মা তা লুকিয়ে না রাখে। এখন আমি আর সেই ছোট্ট টুকটুকি খোকাটি নই। ২০ বছর বয়সী দাঁড়ি-গোঁফ গজানো এক যুবক। আমার কাছে এখন অতীতের মূল্য আছে। সাথে সাথে মূল্য আছে সেই খেলনাগুলোর। যা দিয়ে আমি জীবনের বড় একটা সময় খেলে কাঁটিয়েছি। আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে হয়তো তা আর নেই। কিন্তু বললাম যে, বাবা-মা লুঁকিয়ে রাখলে কখনো হয়তো পাওয়া যাবে। আমার বেলায়ও তা ঘটলো।
দুপুর ১:১৮ মিনিটে মাদরাসা থেকে বাসায় আসলাম। সকাল ৭ টায় গিয়েছি আজ। রাস্তাঘাটের বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে আসতে আমার প্রায় মিনিট বিশেক বা আধ ঘন্টা সময় লাগে। এরই মধ্যে আজকে বাসায় আসার প্রাক্কালে একটা দোকানের সামনে পড়তে পড়তে বেঁচে যাই। কেউ হয়তো সেখানে গুণা তাঁর জমা করে রেখেছিল। আমি অন্যদিকে তাঁকিয়ে হাঁটছিলাম। তখনই অঘটনটি ঘটে। এজন্যই তো গুণী ব্যক্তিরা বলে, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় নজর নিচের দিকে রাখতে হয়।
বাসায় আসার পর আম্মু দরজা খুলে দিলো। প্রতিদিনকার মতো ছোট্টভাই হামিদ দৌড়িয়ে আসলো আমার নিকট। আমি ঘরে ডুকতেই তার এক এক করে আবদার শুরু হলো। “গতকাল আমাকে কার্টূন দেখাও নি। আজকে দেখাতে হবে” বললো হামিদ। আমিও কিছু না বলে দিয়ে দেই। আমি সারাদিন ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে সময় কাঁটাই। আর তারা একটু কার্টূন দেখলে কিই-বা দোষ হয়? তাকে মোবাইলটা দিতেই সে আমার থেকে ঝট করে নিয়ে অন্যরুমে চলে গেল। বাহির থেকে এসেছি মাত্র। ঘমার্ত শরীর আমার। পাঞ্জাবী খুলে খানিকটা ফ্রেশ হয়ে আমি চৌকিতে এসে বসি। হঠাৎ চোখ পড়লো খাটের পাশে থাকা পরিচিত একটা খেলনার প্রতি। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। এটার সাথে আমার একটা অদৃশ্য টান অনুভব করলাম। খেলনাটা হাতে নিতেই মনে পড়লো, আরে এটা তো আমার ছোটবেলার সেই খেলনাটি। কোথা থেকে আসলো আজ? মনে পড়ে গেল পুরোনো সব স্মৃতি। আমরা তখন দুইভাই ছিলাম। আমি আর হোসাইন। (বর্তমানে আমরা ৪ ভাই, ২ বোন।) সম্ভবত ২০০৬ সন চলছে তখন। আমার বয়স সবেমাত্র ৪ বছর। হুসাইনের হয়তো ১ বছর। সঠিক মনে নেই্। সেই বছর আব্বু কোরবানী ঈদের আগে হজ্জ্বে গেলেন। যাওয়ার আগে আমরা ঢাকা থেকে গ্রামে চলে যাই আম্মুর বাড়িতে অর্থাৎ নানাবাড়ীতে। আমার নানা তখন শক্তিসামর্থবান একজন পৌঢ় ব্যক্তি। আমাকে কোলে নিয়ে বাজারে যেতেন। কখনো হাতে চিপস বা চকলেট ধরিয়ে দিতেন। আমার খেলার সঙ্গী ছিল তখন আমার মামাতো ভাই নাইম এবং রায়হান। তারাও তখন ছোট। বর্তমানে দু’জনই প্রতিষ্ঠিত। (আল্লাহ তাদের সচ্ছলতা এবং হালাল রিজিক দান করুন) ঈদ-উল-আযহা গ্রামেই উদযাপন করি। নানার হাত ধরে গ্রামের ছায়ানিবিষ্ট ঈদগাহে যাই। ঈদের সালাত শেষে চলে আসি বাড়িতে। আজকে গরু যবেহ হবে। কিভাবে গরু যবেহ হয়, আগে কখনো দেখি নি। আজ যেন কাছ থেকেই দেখলাম। তারপর প্রতিদিনকার মতো আবার খেলাধূলায় লিপ্ত হয়ে পড়ি। বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। বাচ্চারা খেললে কে আগ বেড়ে তাদের উত্যক্ত করাতে যাবে? ঈদের সপ্তাহখানেক পর আব্বু গ্রামে আসলেন। নানা বললো, হাজি সাব চলে আইছে। আমি তখনো বুঝতাম না, হাজি কাকে বলে? সাথে করে আব্বু অনেক আতর আর জায়নামাজ আনলেন। খেজুর আর জমজমের পানিও আনলেন। আমরা জমজম পান করলাম। এক অপার্থিব পিপাসা যেন নিমিষেই দূরিভূত হয়ে গেল। আমরা ঢাকায় চলে আসলাম। পুরোনো সেই শহরে। সেই পরিচিত ঘরে। যেখানে আমার ছোটভাই হোসাইন জন্ম হয়েছিল। বাসায় এসেই তো আমি পুরো তাজ্জব বনে গেছি। আমার খেলনার তালিকায় আরো কিছু নতুন খেলনা যুক্ত হয়েছে। আব্বু এসব সৌদি আরব থেকে কিনে এনেছেন। সেখানে গাড়ি, লাটিম, বাস, হেলিকপ্টারের মাঝে একটা ভিন্নরকম খেলনা ছিল। ল্যাপটপের আদলে তৈরী সেটি। তখন তো আমি ল্যাপটপ দূরের কথা। কম্পিউটারই দেখি নি। সেখানে “আলিফ” “বা” “তা” “ছা
” এর আদলে বাটন ছিল। একেকটাতে ক্লিক করলে একেকরকম হারামাইনদের ঈমামদের কুরআন তেলওয়াত বাজতো। কোনোটাতে সূরা ফাতেহা, কোনোটাতে সূরা কাফিরুন, কোনোটাতে সূরা ইখলাস। সে সময় সেটা নিয়ে অনেক খেলাধূলাই করেছি। যার সব স্মৃতি আজ ১৪ বছর পরে মনে নেই। হয়তো আব্বু, আম্মুর মনে আছে। বাবা-মায়েরা কখনো সন্তানের সুখের দিনগুলোর কথা ভুলে না। তারা সন্তানের সুখগুলো বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকে লাখো বছর। আমার সেই খেলনাটি অক্ষত আছে আব্বুর কারণে। আব্বু প্রায় সময় খেলনা সর্বদা সামনে রাখতো না। যখন খেলতাম, তখন দিতো। আর অন্য সময় তা আলমারি বা কোনো নিরাপদ স্থানে রেখে দিতো। এভাবেই এটি এখনো অক্ষত। যদি আরো যত্ন নেই, তাহলে আমার বিশ্বাস আমার সন্তানেরাও সেই খেলনার ল্যাপটপটি দিয়ে খেলতে পারবে। তখন আমি তাদেরকে বলবো, এটা তোমার দাদার কারামত। তিনি এটা হেফাজত না করলে হয়তো এটা আমিই ভেঙ্গে ফেলতাম। সেটা হয়তো আজ সমুদ্রের কোনো এক অজানা স্থানে পড়ে থাকতো। কালেভদ্রে তা পঁচে মাছের খাদ্য হতো অথবা কোনো গ্যাসে পরিণত হতো। তাছাড়া প্লাস্টিকের জিনিষ যতই পঁচুক, তা রি-সাইকেল করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। ততদিনে হয়তো আমি আর বেঁচে থাকতাম না এই ধরণীতে। প্রকৃতির লীলাখেলা বুঝতে পারাটা বড়ই দায়!