তুমি স্বাধীন হয়েও কেন পরাধীন থাকতে চাও?

** আব্দুর রহমান আল হাসান **
গত কয়েকদিন আগে আমি একটা কাজে মগবাজার যাচ্ছিলাম। সকালে ঝিরঝির হাওয়া হাঁটতে ভালোই লাগছিল। শীতকাল আসি আসি করছে। এখনো মানুষ কনকনে শীতের সকালে পা দেয় নি। তবে রাতে কাঁথা ছাড়া ঘুমানো এখন একপ্রকার অসম্ভবই বটে। এমন একটি সুন্দর দিনে আমি মগবাজারে যাই। গন্তব্য ইস্কাটন। যখন আমি মগবাজার ওয়ারলেসের সামনে আসি, তখন একটা দৃশ্য দেখি। যা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম চোখের ভুল। পরক্ষণে বুঝতে পারলাম, এটা বাস্তব ঘটনা! খানিকটা হতভম্ব হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুর্ভাগ্য যে, সাথে থাকা আমার মোবাইলে চার্জ ছিল না। শুধু শুধুই সেটা পকেটের এককোণ দখল করে রেখেছিল। তখন হয়তো সেটা ছবি তুলতে পারতাম। ঘটনাটা বলি।
সরকারি বিআরটিসি বাস আমরা ঢাকাবাসীরা সকলেই চিনি। আমাদের কারো কারো নিত্যদিনের গন্তব্যে পৌছে দেয়ার মাধ্যম। সাধারণত বাংলাদেশে এখনো বাসের ড্রাইভার, মহিলা বা মেয়েরা হয় নি। কিন্তু আমি যেটা দেখলাম, তা আমার এই বিশ্বাস ভঙ্গ করতে বাধ্য করেছে। বিআরটিসি বাসের হেলপার একজন ৪৩ বছর বয়সী মহিলা। হেলপার কর্মটা খুবই বিপদজনক কর্ম। এটাতে জীবনের ঝুঁকিও থাকে। সেখানে একজন মহিলার একহাতে টাকা আর অন্য হাতে বাসের গ্রীল ধরে ঝুলে থাকার মধ্যে যে কতুটুকু জীবনের ঝুঁকি থাকে, তা আর বুঝতে বাকী নেই। আজ একশ্রেণীর নারীবাদীরা নিজেদের স্বার্থে নারীদের ঘর থেকে বের করে তাদের চিরায়িত স্বাধীনতাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে নিজেরা নিজেদের সুবিধা মতো নারী স্বাধীনতা বানিয়েছে। আমরা একটু নারীবাদ নিয়ে আলোচনা করি। কোথা থেকে এর সূচনা এবং কেনই বা এমন একটি নীতিমালাকে বিশ্ববাসীর মুখামুখি হতে হলো?
১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি দার্শনিক ও ইউরোপীয় সমাজবাদী “চার্লস ফুরিয়ে” প্রথম ‘নারীবাদ’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়। নারীবাদ বা feminism এবং ‘নারীবাদী’ বা feminist শব্দদুটি ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে এর প্রচলন শুরু হয়। অধিকাংশ পাশ্চাত্য নারীবাদী ঐতিহাসিক মনে করেন যে, যে সমস্ত আন্দোলন নারীর অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে তাদের সবগুলোকেই নারীবাদী হিসেবে গন্য করা উচিত। আর অন্য ঐতিহাসিকরা মনে করেন, নারীবাদী শব্দটি শুধুমাত্র আধুনিক নারীবাদী আন্দোলন ও তার উত্তরসূরি আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই দলের ব্যক্তিরা পাশ্চাত্য নারীবাদীদের ‘উপনারীবাদ’ নামে অবহিত করেন। তবে আধুনিক পাশ্চাত্য নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তিনটি ধারায় বিভক্ত। যেখানে সমাজের কিছূ ব্যক্তি এবং নারীরা মিলে তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে। নারীবাদের প্রথম ঢেউ উঠে উনবিংশ শতকের শেষের দিকে। তখন নারীরা তাদের ভোট প্রধানের অধিকারের জন্য ইউরোপের রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল এবং আন্দোলন করে। প্রথম নারীবাদী আন্দোলন গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যতম অধিকার ভোটাধিকারের জন্য হয়। নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে। তারা নারীমুক্তি আন্দোলন নামে একটা মতাদর্শ ও কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের অধিকারের জন্য চেষ্টা করে। তাদের এই আন্দোলন এশিয়ার অনেক অঞ্চলে প্রভাব ফেলে। তার মধ্যে তুরস্ক ও ইসরায়েল অন্যতম। পাশাপাশি ইউরোপে এটা নিয়ে ব্যপক আন্দোলন হয়। নারীবাদের প্রথম ঢেউ ছিল ভোটাধিকার এবং লিঙ্গ সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য। আর দ্বিতীয় ঢেউ ছিল অনেক ব্যপক একটা বিষয়। যখন প্রথম ঢেউ বিভিন্ন দেশে কার্যকর হওয়া শুরু করে তখন পাশাপাশি নারীদের অবাধ যাতায়াত এবং কর্মক্ষেত্রের ফলে ধর্ষণের মতো মারাত্মক ঘটনার সম্মূখীন হয় তারা। প্রথম ঢেউয়ের পরে যখন অনেক নারী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র এবং সেনাবাহিনীতে, গণমাধ্যমে ও ক্রীড়াজগতে কাজের সুযোগ পায় তখন তারা একের পর এক হয়রানীর শিকার হতে শুরু করে। পারিবারিক বিদ্ধেষ, ধর্ষণ, শ্রেণী বৈষম্যের শিকার হওয়ায় তারা এর থেকে পরিত্রানের জন্য পূনরায় আন্দোলন করে। যা নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ নামে পরিচিত। অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে নারীবাদী যৌনতা বিতর্ক যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সমাপ্তি করে। যৌনতা এবং পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত এই দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের ফলেই ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় নারীবাদের তৃতীয় ঢেউয়ের সূচনা। এই তৃতীয় ঢেউয়ের পর তাদের কতুটুকু অধিকার লাভ করলো তা একটা বিতর্কের বিষয়। কারণ প্রথম ঢেউ আর দ্বিতীয় ঢেউ তাদের অধিকারের জন্য হলেও তৃতীয় ঢেউটিতে তাদের কোনো মৌলিক অধিকার দেখা যায় না। তাই প্রায়ই সময় ইতিহাসবিদ এবং সমাজবিদরা এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে থাকেন।
আমরা এখন দেখি ইসলামে নারীর অধিকার কতুটুকু;
ইসলামপূর্ব অবস্থা যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে সেখানে দেখতে পাই নারীদের কোনো অধিকার নেই। তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা হতো। এমনকি জন্মের পর তাদেরকে জীবিত দাফল করে দেয়ার মতো ঘটনাও ইতিহাসে পাওয়া যায়। তারা নারীদের ভোগের বস্তু হিসেবে মনে করতো। ইসলাম আসার পর নারীদের সবচেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা সূরা আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে বলেন,
إن المسلمين و المسلمات و المؤمنين و المؤمنات و القانتين و القانتات و الصادقين والصادقات و الصابرين و الصابرات و الخاشعين و الخاشعات و المتصدقين و المتصدقات و الصاءمين و الصاءمات و الحافظين فروجهم و الحافظات و الذاكرين الله كثيرا و الذاكرات أعد الله لهم مغفرة و أجرا عظيما
“মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী.মু’মিন পুরুষ এবং মু’মিন নারী, অনুগত পুরুষ এবং অনুগত নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ এবং ধৈর্যশীল নারী, বিনয়ী পুরুষ এবং বিনয়ী নারী, দানশীল পুরুষ এবং দানশীল নারী, রোযাদার পুরুষ এবং রোযাদার নারী, যৌনাঙ্গের হেফাজতকারী পুরুষ এবং যৌনাঙ্গের হেজাফতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী- আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও উত্তম প্রতিদান।”
বিভিন্ন নাস্তিক এবং অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজেদের অজ্ঞতাবশত বলে থাকেন, ইসলামে নারীদের ঘরের বাহিরে যেতে কঠোরতা আরোপ করেছে। অথচ আল্লাহ তা’আলা সূরা আহযাবের ৫৯ নম্বর আয়াতে বলেন,
يا آيها النبي قل لأزواجك و بناتك و نساء المؤمنين يدنين عليهن من جلا بيبهن، ذلك أدنى أن يعرفن فلا يؤذين، وكان الله غفورا رحيما
“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে এবং আপনার কন্যাদেরকে ও মু’মিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন (ঘরের বাহিরে যাওয়ার সময়) চাদরের কিছু অংশ দিয়ে নিজেদের ঢেকে নেয়। এতে তাদের পরিচয় চেনা সহজতর হবে এবং তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ”
ইসলামে প্রয়োজনের খাতিরে নারীদের ঘরের বাহিরে যাওয়ার অনুমতি আছে। তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ও অনুমতি আছে। স্বয়ং সাহাবাদের মধ্যে অনেক নারী ছিলেন, যারা বীর যোদ্ধা এবং আলেম মুফতী ছিলেন। হাদীসে আছে, “মাহরামের উপস্থিতি ব্যতিত কোনো নারী সফর করতে পারবে না।” মনে হতে পারে, এটা কঠিন। কিন্তু একটু বিবেক দিয়ে চিন্তা করলেই এর প্রয়োজন এবং বাস্তবতা বুঝে আসবে।
সুতরাং মুসলিম নারীদের প্রচলিত নারীবাদীদের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া হবে বোকামির পরিচয়। তারা আন্দোলন করছে, তাদের সম্মানের জন্য। মুসলিম নারীদের তো স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই সম্মান দিয়েছেন। তার আলাদাভাবে স্লোগান তুলে, রাজপথ গরম করে নিজের অধিকার আদায় করার কেনো প্রয়োজন নেই।

#buttons=(আমি সম্মত !) #days=(20)

আসসালামু আলাইকুম, আশা করি আপনি ভালো আছেন। আমার সম্পর্কে আরো জানুনLearn More
Accept !