কর্ম ও কর্মী - আব্দুর রহমান আল হাসান

6 minute read

মানব জীবনের অপরিহার্য একটি যোগান হলো, খাদ্য। মানুষের শরীর সুস্থতার জন্য, মন ও মস্তিষ্ক সঠিকরুপে পরিচালনার জন্য খাদ্য একটি অপরিহার্য বিষয়। পৃথিবীতে যত ধরনের অপরাধ ঘটে, সবকিছুর মূলে এই খাদ্য। মানুষ খাবার না পেলে লুটপাট ও চুরি-ডাকাতি করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তার নিকট তখন দুনিয়ার সকল অপরাধ বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু সমাজের নিকট সে হয়ে যায় একজন দাগী অপরাধী। তাই মানুষ খাদ্যের জন্য কর্মে যোগদান করে। কে কি কর্ম করবে, এর পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তির দক্ষতা ও চাহিদার উপরে।

আব্দুর রহমান আল হাসান

ধরা যাক, কেউ ব্যবসা করতে পারদর্শী। সে বুঝতে পারে, বাজারে কখন কোন জিনিষটি প্রয়োজন। তাহলে তার ব্যবসা করা উচিৎ। কেউ বা কল-কারখানা পরিচালনা করতে কিংবা সেখানে কাজ করতে পারদর্শী। তাহলে তার সেখানেই কাজ করা উচিৎ। মানব জীবনে কর্মের সাথে খাদ্যের যোগসুত্র প্রাচীনকাল থেকেই।

একটা সময় মানুষ ব্যবসা বা অন্য কোনো কর্মের সাথে যুক্ত ছিল না। তখনও কিন্তু তারা শিকারের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য জোগাড় করেছে। অর্থাৎ যে কোনো পরিস্থিতিতে খাদ্য সকলের জন্য অপরিহার্য।

আমি এখানে খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য কিছু ঘটনা উল্লেখ করছি।

ঘটনা এক……..

সবেমাত্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছি। প্রতিমাসে প্রায় ইন্সটিটিউট খরচ প্লাস সেমিষ্টার ফির কিস্তি প্লাস গাড়িভাড়া মিলে পাচঁ-দশ হাজার খরচ হয় আমার। এত এত টাকা আমি কেন খরচ করছি? আল্লাহ চাহে তো আমি যেন ভবিষ্যতে বেকার না বসে থাকি। খানিকটা কর্মে যোগদান করে আমার পরিবারের ব্যাকআপ দিতে পারি।

ঘটনা দুই………

ইন্সটিটিউট ছুটি হয়ে গেছে দুপুর সাড়ে এগারোটায়। বাসায় ফেরার জন্য বের হয়েছি। মাথার উপরে কাঠফাটা রোদ। তীব্র গরম চরিদিকে। সূর্যের আলো যেন লেলিহান শিখার ন্যায় দাউদাউ করে জ্বলছে। এর মধ্যেই “অ্যাই যাবেন কারওয়ান বাজার, ইস্কাটন, মগবাজার, ওয়ারলেস, মৌচাক, রামপুরা, বনশ্রী” বলে লোক ডাকছে বাসের হেলপাররা। তারা সারাদিন এত কষ্ট কেন করে? তীব্র রোদে ঘমার্ত শরীরে বাসের ভ্যাপসা গরমে তারা ধৈর্যের সাথে মানুষকে ডাকছে তার বাসে উঠার জন্য। তারও পরিবার আছে। তারও সন্তান আছে। তারও মা – বাবা আছে। একটু কষ্ট সহ্য করে তাদের মুখে হাসি ফুটাচ্ছে। মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে।

ঘটনা তিন…………

ইন্সটিটিউট ছুটি হওয়ার পর রাস্তার এত বিশাল জ্যাম দেখে বাসে উঠার মনমানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়। এর থেকে হেঁটে গেলেও আরো তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। হাঁটছি এত এত লোকের মধ্যে। সকলেরই তাড়া আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে বাসগুলো। এক একটা বাস যেন এক একটা জলন্ত হিটার। বাসের হেলপাররা ঘমার্ত শরীর নিয়ে রাস্তার পাশে থাকা গাছের ছায়ায় বসে আছে।

চোখ পড়লো একজন হেলপারের দিকে। তার বাম পা নেই। হয়তো কোনো দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন তিনি। এক পা ও সাথে স্ট্রিট নিয়ে বাসে হেলপারের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তারও একটা পরিবার আছে। চাইলে তিনি অন্যান্যদের মতো  মানুষের দয়া-দক্ষিণা নিয়ে চলতে পারতেন। আত্মসম্মান তাকে তা করতে দেয় নি। তিনি কর্মের মধ্যেই সস্ত্বি খুঁজে পেয়েছেন।

ঘটনা চার…………….

কাওরান বাজারের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম বাস না পেয়ে। রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। একজন ব্যক্তি খুব জোরে হেটে আসছেন। রাস্তা পার হওয়ার আগেই পুলিশ সিগন্যাল ছেড়ে দিল। লোকটি রাগে গজগজ করতে করতে বলতে লাগলেন, “আর থাকমু না ঢাকায়। বাড়ি চলে যামু”। তিনি চাইলে যেতে পারেন। কিন্তু তার একটা পরিবার আছে। বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা অথবা শশুর-শাশুড়ি আছে। আছে ছোট্ট ছোট্ট সন্তান। কাদের জন্য এত খাটেন তিনি?

ঘটনা পাঁচ……………

আমার বাবা আমার নিকট পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বাবা। যখন যেটার আবদার করেছি, পেয়েছি। কিভাবে পেয়েছি, তা আল্লাহই ভালো জানেন। ঢাকা শহরে দশ-পনেরো হাজার টাকার চাকুরী করে আমাদের বাসায় যে প্রতিদিন রান্না হচ্ছে, এর জন্যই বা কয়দিন শুকরিয়া আদায় করেছি আমি?

বড়ই অকৃতজ্ঞ আমরা! বড়ই নিমকহারাম আমরা! আমাদের পরিবার আমাদের পেছনে যেভাবে টাকা-পয়সা খরচ করে সেটা নিয়ে কয়দিন ভেবেছি? কখনো কি দেখেছি, টাকা কোথা থেকে আসে?

আমরা আজ থাকি কিছু আবালমার্কা পাওয়ার নিয়ে। বাবার টাকা নষ্ট করে আমরা বন্ধুদের নিয়ে আড্ডাবাজি করতে ও তাদের সাথে নিয়ে নাস্তা করতে একটুও দ্বিধাবোধ করি না। নিজে একটু চেষ্টা করে দেখুন, একশত টাকা উপার্জন করতে কতটা কষ্ট করা লাগে?

ছোটবেলায় বা উঠতি বয়সে অনেকেই রাগারাগি করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়? কোনো এক আত্মীয়দের বাসায়। বা কোনো পরিচিত কারো বাসায়। দুইদিন পর ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে আসে। সে কেন ঘর থেকে বের হয়ে উপার্জনে নামতে পারলো না? কেন সে পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার পরে নিজেকে অসহায়রুপে আবিষ্কার করলো? কারণ, কেউ তাকে ফ্রি ফ্রি খাওয়াবে না। কেউ তাকে ফ্রিতে বা দয়া করে ভাত খাওয়াবে না ইলিশ মাছ দিয়ে বা গরুর গোশত দিয়ে।

প্রতিটি ব্যক্তিই অঘোষিতভাবে খাবারের পেছনে নিজের সময় ব্যয় করে। কিন্তু এদের বাহিরেও কিছু অপদার্থ আছে। তাদের গল্পও কিছুটা বলা দরকার। না হয় বিবেক আমাকে ক্ষমা করবে না।

ঘটনা এক……

সাতার শেখার জন্য বিদেশ ভ্রমন করতে হয় না। যে কোনো পুকুরে বা কোনো সুইমিংপুল থেকে সহজেই সাতার শেখা যায়। এর পরও দেশে কিছু কর্মকর্তা রয়েছে, যারা স্রেফ সাতার শেখার নাম করে কোটি টাকা নিজের জন্য বরাদ্দ করে। এরপর জনগণের টাকা নিয়ে যায় সাতার শিখতে। 

তারাও পেটের দায়ে জনগণের টাকা পয়সা মেরে দেয়। তারাও অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজের পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটায়। কিন্তু এই হাসির অর্থ কি?

ঘটনা দুই…….

দেশে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতিত্ব করে সিন্ডিকেট করা ব্যবসায় যখন তারা কালোবাজারি শুরু করে, গরীবের পেটে তখন আর খাবার পড়ে না। যখন তেলের দাম বেড়ে হয় দুইশত টাকার বেশি, যখন অর্থনৈতিকভাবে টাকার মান কমতে থাকে তখন স্বভাবগতই প্রশ্ন আসে, আমরা কি এমন উন্নয়ন চেয়েছিলাম?

যাই হোক, নিজের দোষ বলতে মানা । এভাবেই জনগণের টাকা চলে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে ও নির্লজ্জ রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। 

এবার একটু দেশের অন্যতম সংকট ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বলি। কারণ, তারাও ভিক্ষা করে পেটের দায়ে। ক্ষুধার তাড়নায়। খাদ্যের অভাবে।

নবীজি হজরত মুহাম্মদ সা. ভিক্ষাবৃত্তিকে অপছন্দ করতেন। কোনো ভিক্ষুক চোখে পড়লেই তাকে কাজের পথ দেখিয়ে দিতেন। একটি ঘটনা তো বেশ পরিচিত। এক লোক নবীজির কাছে এসে ভিক্ষা চেয়েছিল। নবীজি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে বিক্রি করার মতো কী আছে? লোকটি একটি কম্বল এনে বলল, এটা বিক্রি করা যায়। নবীজি সেটা বিক্রি করে কিছু টাকা দিয়ে খাবার খেতে বললেন, আর কিছু টাকা দিয়ে একটি কুড়াল কিনে দিলেন। বললেন, এবার বনে গিয়ে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করো।

আমরা মানবিক ও সামাজিক বোধের কারণে ভিক্ষুকদের দান খয়রাতও দিয়ে থাকি। অনেকে আবার চক্ষুলজ্জা ভিক্ষুকদের এড়াতে পারেন না। যার ফলে ভিক্ষাবৃত্তি এখন আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেই। সিন্ডিকেটরা একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। এমনকি কৃত্রিম উপায়ে সুস্থ সবল মানুষকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে অনেক চক্র। কিন্তু বর্তমানে রীতিমতো এসব প্রতিষ্ঠান এবং চক্রগুলোতে তিনবেলা খাবার এবং থাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দিনের পুরোটা সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষা করাচ্ছেন।

এমন ধোঁকা ও শঠতাকে ইসলামে স্পষ্ট হারাম। মহানবী হযরত মহাম্মদ(সা.) প্রবঞ্চনাকারীকে নিজের উম্মত নয় বলে ধমকি দিয়েছেন।

ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে আমাদের করণীয় কি?

হাদিসে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে সেই ব্যাক্তিই প্রকৃত ধনী যিনি মনের দিক থেকে ধনী। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালার দানের প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়ে যতটুকু সম্পদ তিনি দান করেছেন, সেটার প্রতিই সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। এবং জীবনযাপন করাই হলো বান্দার সব থেকে বড় সফলতা।

এ ব্যাপারে রসুল (স.) হাদিসে বলেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি জীবনে সফলতা লাভ করেছে, যে ইসলাম কবুল করেছে এবং তাকে যে পরিমাণ রিযিক তথা সম্পদ দেওয়া হয়েছে তার ওপরেই সে পরিতৃপ্ত হয়েছে।’(মুসলিম: ২৩১৬)।

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যমিনে বিচরণকারী সবার জীবিকার দায়িত্ব একমাত্র (আমি) আল্লাহরই ওপরে।’(সুরা হুদ:০৬)

অনেকেই মনে করেন, আমি ঘরে বসে আল্লাহর ইবাদত করলে আল্লাহ মনে হয় গায়েব থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করে দিবেন। এটা এক দৃষ্টিতে ভুল ধারণা। এই ভুল ধারণা সমাজে ছড়িয়ে পড়ার জন্য আমাদের হুজুর সমাজেরও দায় রয়েছে। তারা জাল হাদীস ও ভুলভাল কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারদর্শী। তাদের ব্যাপারে আল্লাহর নিকট পানাহ চাচ্ছি। আল্লাহ কুরআনে সূরা জুমআর ১০ নং আয়াতে বলেন, 

فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰهِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰهَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ۱۰  

অতঃপর যখন সালাত (নামাজ) সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে রিযিক  অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা রিযিকের জন্য চেষ্টা করো। তিনি বান্দাকে ঘরে বসে যিকির করতে বলেন নি। তিনি বান্দাকে ইবাদাতের পর যমীনে ছড়িয়ে পড়তে বলেছেন। মানুষকে তিনি চেষ্টা করতে বলেছেন। কর্মের মাধ্যমে রিযিকের সন্ধান করতে বলেছেন। 

যদি মনে হয়, চেষ্টা করেও তো আমি সফল হচ্ছি না। তাহলে ভাবতে হবে, আমার চেষ্টাটা ঠিকমতো হচ্ছে না। আমাকে আরো ভালোভাবে এগুতে হবে। আমাকে আরো অগ্রসর হতে হবে। হাদীসে আছে, “চেষ্টা আমাদের। আর সফল করার দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলার। 

খলিফা আবু বকর রা. এর যামানা

খলিফা ওমর রা. এর যামানা

#buttons=(আমি সম্মত !) #days=(20)

আসসালামু আলাইকুম, আশা করি আপনি ভালো আছেন। আমার সম্পর্কে আরো জানুনLearn More
Accept !