প্রথম শিয়া খলিফা উবায়দুল্লাহ মাহদীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

0

শিয়া সাম্রাজ্য পৃথিবীতে ২৯৮ হিজরীতে প্রতিষ্ঠা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতার নাম, উবায়দুল্লাহ মাহদী। আর তাদের সাম্রাজ্যের নাম ছিল, ফাতেমী সাম্রাজ্য। উবায়দুল্লাহ মাহদী ক্ষমতায় বসার পর থেকেই আশেপাশের আরো বহু এলাকা ও সাম্রাজ্য নিজের এলাকার সাথে যুক্ত করার প্রয়াস করছিল। উবায়দুল্লাহ সেকালের ইসলামী খেলাফত আব্বাসীদেরকে দুচোখে দেখতে পারতো না। সর্বদা চাইতো তাদের টুটি চেপে ধরতে। কিন্তু কখনো পারে নি। উবায়দুল্লাহ মাহদীর বিরুদ্ধে বড় বড় বিদ্রোহগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, তারাবলুসে বিদ্রোহ ও বারাকাবাসীর বিদ্রোহ। এখানে আমরা এই তিনটা নিয়েই আলোকপাত করছি।

তারাবলুস বিদ্রোহ:

তারাবলুসকে ইংরেজিতে ত্রিপলি বলা হয়। এটি বর্তমান লেবাননের বৃহত্তম দ্বিতীয় শহর। এই শহর লেবাননের রাজধানী বৈরুত থেকে ৮৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত। উবায়দুল্লাহ মাহদী যুদ্ধের মাধ্যমে তারাবলুস (ত্রিপলি) দখল করে নেয়। সেখানে সে মাকনূন কাত্তামীকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করে। কিন্তু উক্ত অঞ্চলের হাওয়ারা গোত্রের অধিবাসীরা মাকনূনকে পছন্দ করতো না। তাই তারা নতুন গভর্নরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। আর এই বিদ্রোহে হাওয়ারা গোত্র একাই ছিল না। তাদের সাথে যানাতা, লিমায়া ও বারাবারিয়ান গোত্রগুলোও যোগ দেয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্রোহীদের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়।

এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিল আবু হারুন হাওয়ারী। বিদ্রোহীরা একত্র হয়ে মাকনূনের বাসভবন অবরোধ করে। মাকনূন কোনক্রমে আত্মরক্ষা করে বেঁচে ফিরে। উবায়দুল্লাহ মাহদী এই বিদ্রোহের খবর জেনে মাকনূনের ভাই তাম্মাম এর নেতৃত্বে একটা সেনাদল পাঠায়। এদিকে আবার উবায়দুল্লাহ মাহদী মাকনূনকে ইঙ্গিতে বলে দেয়, বিদ্রোহ দমন করার পর যেন তাম্মামকে হত্যা করা হয়। কারণ, দুই ভাই একত্রে থাকলে ক্ষমতা নিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

২৯৮ হিজরীতে মাকনূন তার ভাইয়ের সাহায্যে বিদ্রোহ দমন করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনে। এরপর সে তার ভাইয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে উবায়দুল্লাহ মাহদীর নির্দেশে তাম্মামকে হত্যা করে। হত্যার পর তার নিজের গোত্র অর্থাৎ কাত্তামী গোত্র যেন প্রশ্ন না তুলে তাই তাদেরকে শহরে অবাধে লুটপাট করার অনুমতি দেয়। এর ফলে ৩০০ হিজরীতে তারাবলুসের (ত্রিপলী) গোত্রগুলো একত্র হয়ে দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ করে। এবার আর বিদ্রোহকারীরা মাকনূনকে ছাড়ে নি। তাকে শহর থেকে বের করে দেয়। এমনকি মাকনূনের সাথে সাথে তার সহযোগী ও তার নিজের গোত্র কাত্তামী গোত্রকেও বের করে দেয়া হয়।

মাকনূন পালিয়ে গিয়ে উবায়দুল্লাহ মাহদীর আশ্রয় নেয়। উবায়দুল্লাহ মাহদী বুঝতে পারে, এবার শহরটি উদ্ধার করা অনেক কঠিন হবে। তাই সে নৌপথে আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। যখন ‍উবায়দুল্লাহর নৌবাহিনী তারাবলুসের নিকট চলে আসে তখন তারাবলুসের নৌবাহিনী শত্রুপক্ষকে জ্বালিয়ে দেয়। তারাবলুসের অধিবাসীরা জানতো, এই শহর আবার দখল করতে হলে নৌপথেই আক্রমনটা হবে। তাই তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তারাবলুসের নৌবাহিনীর আক্রমণে উবায়দুল্লাহ মাহদীর অনেক সৈন্য মারা যায়।

উবায়দুল্লাহ তখন তার পুত্র আবুল কাসিমের নেতৃত্বে স্থলপথে আরেকটা বাহিনী প্রেরণ করে। এই বাহিনী শহরের বাহিরে হাওয়ারা গোত্রের সাথে লড়াই করে। কিন্তু হাওয়ারা গোত্র আবুল কাসিমের বাহিনীর সামনে টিকে থাকতে পারে নি। তারা পরাজয়বরণ করে। এরপর তারা শহরের দিকে অভিমুখি হয়।

শহরবাসীরা যখন দেখলো বিপদ আসন্ন তখন তারা শহরের ফটক বন্ধ করে দিল। আবুল কাসিমও শহরের বাহিরে অবরোধ করে রাখলো। এর ফলে শহরের ভেতরে খাদ্যের সংকট দেখা দিতে লাগলো। লোকজন তখন বাধ্য হয়ে মরা প্রাণীর গোশত খেত। এরমধ্যে শহরের কিছু ব্যক্তিরা আবুল কাসিমের নিকট এসে শান্তিচুক্তির আবেদন করলো। কিন্তু সে বললো, শহরের তিনজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। যারা বিদ্রোহীদের উষ্কানী দিয়েছিল।

শহরবাসী বাধ্য হয়ে তিনজনকে হস্তান্তর করে। আবুল কাসিম তাদেরকে হত্যা করে শহরে প্রবেশ করে। সে জনসাধারণের উপর তিন লক্ষ দিনার জরিমানা ধার্য করে। তারাবলুসের (ত্রিপলির) পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর আবুল কাসিম রাকাদা ফিরে যায়। এই বিদ্রোহে একটা জিনিষ স্পষ্ট যে, তারাবলুসের অধিবাসীরা উবায়দিয়াদের বিন্দুমাত্র পছন্দ করতো না।

বারাকা বিদ্রোহ:

তারবলুসের পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর উবায়দুল্লাহ মাহদী বারাকা অভিমুখে সৈন্য প্রেরণ করে। (বারাকা বর্তমানে কোথায় অবস্থিত, আমার জানা নেই। তবে ত্রিপলির আশেপাশে হতে পারে। কেউ জেনে থাকলে আমাকে জানালে উপকৃত হবো) এখানে এসেই উবায়দুল্লাহর সৈন্যরা হত্যা, লুটপাট ও ধ্বংসাত্মক কাজ করতে থাকে। এর ফলে ৩০২ হিজরীতে বারাকাবাসী বিদ্রোহ করে। তারা উবায়দিয়দের ও কাত্তামা গোত্রের পুরুষদের হত্যা করে।

ফলে উবায়দুল্লাহ মাহদী ক্রুদ্ধ হয়ে ৩০৩ হিজরীতে সৈন্যদল পাঠায়। তারা ১৮ মাস বারাকা অঞ্চল অবরোধ করে রাখে। এরপর ৩০৫ হিজরীতে উবায়দুল্লাহর সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করে। এভাবেই এই শহরটিও উবায়দুল্লাহ দখল করে নেয়।

এর মাধ্যমে এখানে শেষ করছি ফাতেমী সাম্রাজ্যের সূচনালগ্নে শহর দখল ও বিদ্রোহ নিয়ে আলোকপাত। উবায়দুল্লাহ মাহদী কিভাবে মৃত্যুবরণ করে সেটা সম্পর্কে কোনো তথ্য আমি পাই নি। তবে এটা জানি, সে ৩২২ হিজরী পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় থাকে। সে ক্ষমতায় এসেছিল ২৯৮ হিজরীতে। মৃত্যুবরণ করে ৩২২ হিজরীতে। অর্থাৎ প্রায় ৩৪ বছর সে শাসন ক্ষমতায় অতিষ্ঠিত থাকে। তার পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসে তার ছেলে আবুল কাসেম।

পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুুন

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(আমি সম্মত !) #days=(20)

আসসালামু আলাইকুম, আশা করি আপনি ভালো আছেন। আমার সম্পর্কে আরো জানুনLearn More
Accept !